সম্পত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকার দলিল

0

সম্পত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকার দলিল

Deed
সম্পত্তি কেনাবেচা : বিভিন্ন প্রকার দলিল
একখণ্ড জমি বা সম্পত্তির মালিক কিভাবে বুঝবেন তিনিই মালিক? জমিজমা বা স্থাবর সম্পত্তির দখলই শুধু মালিকানা নয়। মালিকানার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কাছে থাকা চাই। ওই কাগজপত্রকেই আমরা দলিল বুঝি। সাধারণভাবে দলিলের ভাষা ও বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হয়। আর এ কারণে সাধারণ মানুষের জন্য দলিল পড়ে এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া কঠিন। অথচ সবাইকে দলিল নিয়ে কমবেশি কাজ করতে হয়। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিরোধের উৎসও জমিজমাসংক্রান্ত। বাংলাদেশের আদালতে বিচারাধীন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার প্রায় ৮০ শতাংশই জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের ধারাবাহিকতায় হয়ে থাকে।
 তিন-চার পুরুষ ধরে মৌখিক বণ্টনের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় জমি ভোগদখলের মাধ্যমে ব্যবহার করে এসেছে। কিন্তু সরকারি নথিপত্রে তা উল্লেখ করা হয়নি। এসব কারণে দেখা যায়, ৫০-৬০ বছর আগে কারো দাদা বা পরদাদার নামে জমি বণ্টনের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি হয়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হালনাগাদ না থাকায় সাধারণ মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়।
 এ অবস্থায় ভূমিসংক্রান্ত কাগজপত্রে জটিলতা কমিয়ে একে সাধারণ মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য করে তুলতে প্রায় ১০০ বছর আগের সম্পত্তি হস্তান্তরের বিধান সংশোধন করা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন সংশোধন আইন ২০০৪-এ কোনো স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করার জন্য রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইন সংশোধন করা হয়। সম্পত্তি হস্তান্তর সহজ করার জন্য সংশোধিত আইনে সম্পত্তি হস্তান্তর দলিলের নমুনা ফরম দেওয়া হয়েছে।
 ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী ১০০ টাকার কম মূল্যের স্থায়ী সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক ছিল না। বাস্তবে ১০০ টাকা মূল্যের কোনো স্থাবর সম্পত্তি বর্তমানে না থাকলেও অনেকে কম মূল্য দেখিয়ে সম্পত্তি হস্তান্তর করছে। সরকারিভাবে এই হস্তান্তরের কোনো রেকর্ড না থাকায় সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। তাই সরকার আধুনিক ও দক্ষ ভূমি ব্যবস্থাপনার স্বার্থে যেকোনো মূল্যের সম্পত্তি হস্তান্তরে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করে আইন করেছে। নিচে বিভিন্ন রকম দলিল নিয়ে আলোচনা করা হলো।
 সাফ কবলা
কোনো ব্যক্তি তাঁর সম্পত্তি অন্যের কাছে বিক্রি করে যে দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে দেন, তাঁকে সাফকবলা বা বিক্রয় কবলা কিংবা খরিদা কবলা বলা হয়। এই কবলা নির্ধারিত দলিল স্ট্যাম্পে লেখার পর দলিলদাতা অর্থাৎ বিক্রেতা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিত হয়ে দলিল সহি করে গ্রহীতা অর্থাৎ খরিদ্দারের বরাবর রেজিস্ট্রি করে দেবেন। এই দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলিলের তফসিলে লিখিত অর্থাৎ বিক্রীত ভূমির যাবতীয় স্বত্ব দলিলদাতার কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়। দলিল গ্রহীতার ওপর ওই সম্পত্তির মালিকানা অর্পিত হলো। দলিলদাতা ওয়ারিশানক্রমে ওই জমি থেকে নিঃস্বত্ববান হলেন।
 দান-পত্র দলিল
যেকোনো সম্প্রদায়ের যেকোনো ব্যক্তি তাঁর সম্পত্তি যে কাউকে দান করতে পারেন। এই দানপত্র দলিলে শর্তবিহীন অবস্থায় সব ধরনের ক্ষমতা প্রদানের দান করতে হবে। স্বত্ব সম্পর্কে দাতার কোনো প্রকার দাবি থাকলে দানপত্র শুদ্ধ হবে না।
 হেবা দলিল
মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এই হেবা অর্থাৎ দানপত্র দলিল। এই দলিল কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়, কেবল সন্তুষ্ট হয়ে এরূপ দান করা হয়। কিন্তু এই হেবা শর্তবিহীন অবস্থায় দান বিক্রি, কট, রেহান, রূপান্তর ইত্যাদি সব ক্ষমতা প্রদানে দান বা হেবা করতে হবে। স্বত্ব সম্পর্কে দাতার কোনোরূপ দাবি থাকলে সেই দান বা হেবা শুদ্ধ হবে না এবং তা যেকোনো সময় বাতিলযোগ্য। এরূপ দানপত্রে দাতার কোনো স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে না।
 হেবা বিল এওয়াজ
হেবা বিল এওয়াজ মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি দানপত্র দলিল। এই দানও সন্তুষ্ট হয়ে করা হয় বটে কিন্তু এটা কোনো কিছুর বিনিময়ে হয়ে থাকে। যেমন_পবিত্র কোরআন, জায়নামাজ, তসবিহ, মোহরানার টাকা, এমনকি যেকোনো জিনিসের বিনিময়েও হতে পারে, যেমন আংটি ইত্যাদি। এই হেবা বিল এওয়াজ দলিল সম্পূর্ণ শর্তবিহীন অবস্থায় গ্রহীতা যাবতীয় হস্তান্তর ও রূপান্তরের সব রকম ক্ষমতার অধিকারী হবেন এবং দাতার যাবতীয় স্বত্ব গ্রহীতাতে অর্পিত হবে। দাতার স্বার্থে কোনো প্রকার স্বত্ব দাতার জন্য সংরক্ষিত থাকলে দলিল শুদ্ধ হবে না। এই দলিল অবশ্যই রেজিস্ট্রি হতে হবে। হেবা বিল এওয়াজ যদি টাকার বিনিময়ে হয় এবং ক্রমিক ওয়ারিশি সূত্রে আগেপরে তিন ধাপের পরের ব্যক্তিকে বা তৃতীয় ব্যক্তিকে হেবা বিল এওয়াজ মূলে দান করে থাকে, তাহলে শরিক কর্তৃক জানার তারিখ থেকে চার মাসের মধ্যে প্রিয়েমশন মামলা করতে পারে।
 এওয়াজ দলিল
যেকোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সঙ্গে তাদের মধ্যে কোনো স্থাবর সম্পত্তি বদলি করতে পারেন। অর্থাৎ তাদের সুবিধামতো একের ভূমি অপরকে দিতে পারেন। এই দলিল অবশ্যই রেজিস্ট্রি হতে হবে। এওয়াজ পরিবর্তন দলিলের একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হলো : ক-এর জমি খ-এর বাড়ির কাছে এবং খ-এর জমি ক-এর বাড়ির কাছে। উভয়ের জমিই উভয়ের বেলপ্ত। কাজেই ক তার জমি খ-কে এবং খ তার জমি ক-কে দিয়ে উভয়ে একটি দলিল সম্পাদন করে রেজিস্ট্রি করে নিল। একেই এওয়াজ পরিবর্তন দলিল বলে। এই দলিলের কেউ প্রিয়েমশন করতে পারে না।
 বণ্টননামা দলিল
শরিকদের মধ্যে সম্পত্তি ক্রমে নিজ নিজ ছাহামপ্রাপ্ত হয়ে ওই অংশের জন্য যে দলিল করতে হয়, তাকে বণ্টননামা দলিল বলে। একই সম্পত্তিতে মালিক একই বংশের লোককে সাধারণত শরিক বলা হয়। শরিক দুই ধরনের, যথা_উত্তরাধিকার সূত্রে শরিক বা কোনো শরিক থেকে খরিদ সূত্রে শরিক। ইংরেজিতে বলা হয় কো-শেয়ারার বাই ইনহেরিটেন্স অ্যান্ড কো-শেয়ারার বাই পারচেজ। বণ্টননামা দলিল করার সময় সব শরিক দলিলে পক্ষভুক্ত থেকে ও দস্তখত করে বণ্টননামা দলিল করতে হয়। কোনো একজন শরিক বাদ থাকলে বণ্টননামা শুদ্ধ হবে না। বণ্টননামা দলিল রেজিস্ট্রি করতে হবে কিন্তু ঘরোয়াভাবে বণ্টন করে সব পক্ষ যদি বণ্টননামা দলিলে দস্তখত করে থাকেন, তাহলেও বণ্টননামা কার্যকর হতে পারে। যদি শরিকরা আপস মতে বণ্টন করতে রাজি না হন, তাহলে যেকোনো শরিক বণ্টনের জন্য আদালতে নালিশ করতে পারেন।
 অসিয়তনামা দলিল
কোনো ব্যক্তি তাঁর সম্পত্তি কাউকে বা তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অসিয়তকারী ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সবাইকে না দিয়ে যদি একজনকে বা কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে প্রদান করে থাকেন এবং অসিয়তকারীর মৃত্যুর পর যদি তাঁর উত্তরাধিকারী দাবি করেন, তাহলে যাঁকে সম্পত্তি অসিয়ত করা হলো, সেই ব্যক্তি সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পাবেন এবং অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশের মালিক উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সবাই হবেন।
 উইল দলিল
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক তাঁদের নিজস্ব সম্পত্তি তাঁদের আত্মীয়দের মধ্যে যাঁকে ইচ্ছা উইল করে দিতে পারেন। যিনি উইল করলেন, তিনি জীবনে একের অধিক উইল করতে পারেন। কিন্তু সর্বশেষ যে উইল করলেন, কেবল সেটাই কার্যকর হবে।
 না-দাবি দলিল
কোনো ব্যক্তি সুনির্দিষ্ট কোনো সম্পত্তিতে তাঁর স্বত্বাধিকার নেই মর্মে অথবা স্বত্ব্বাধিকার ত্যাগ করছেন মর্মে দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে দিতে পারেন। এ রকম দলিলকে নাদাবি দলিল বলা হয়।
 বয়নামা দলিল
প্রজাদের ভূমি রাজস্ব বাকি পড়লে মালিকরা আদালতে খাজনার নালিশ করে ডিক্রি করতেন। প্রজা ওই ডিক্রিকৃত টাকা জমিদারকে প্রদান না করলে ওই খাজনার ডিক্রিজারি দিয়ে ভূমি নিলাম করাতেন। ওই জমিটি মালিকসহ সর্বসাধারণের খরিদ করার অধিকার ছিল। যে ব্যক্তি অধিক টাকায় নিলামের ডাক ওঠাতেন, তিনি জমিটির খরিদ্দার বলে গণ্য হতেন। যিনি নিলাম খরিদ করতেন, তাঁকে একটি নিদর্শনপত্র বা সার্টিফিকেট দেওয়া হতো। একে বয়নামা বলা হয়।
 দখলনামা দলিল
বণ্টনের মোকদ্দমা, স্বত্ব সাব্যস্তপূর্বক খাস দখল, উৎপাত ও প্রিয়েমশন মামলায় ডিক্রির পর আদালত বণ্টনের মামলায় কমিশনার ও অন্যান্য মোকদ্দমায় আদালতের পদাতিক বা নায়েব, নাজিরযোগে ডিক্রি অনুযায়ী দখলি পরোয়ানার ভিত্তিতে দখল গ্রহণ করতে হয়। দখল হওয়ার পর কমিশনার ও আদালতের পদাতিক বা নায়েব নাজির রিপোর্টসহ ওই দখলি পরোয়ানা আদালতে দাখিল করেন। একে দখলনামা দলিল বলা হয়।
 ডিক্রি দলিল
রায়ের মর্মমতে রায়ের আদেশ সংযোজন করে বাদী ও বিবাদীপক্ষের নাম-ঠিকানাসহ সম্পত্তিসংক্রান্ত হলে সম্পত্তির তফসিল পরিচয়সহ যে দলিল আদালত কর্তৃক জারি করা হয় তাকে ডিক্রি দলিল বলে।
 আদালতযোগে সাফকবলা দলিল
কোনো ব্যক্তি তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য কারো কাছ থেকে বায়না বাবদ টাকা গ্রহণ করে বায়নাপত্র সম্পাদন করে দিয়ে যদি দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে না দেন, তাহলে যে ব্যক্তি বায়না দিয়েছেন, তিনি আদালতযোগে নালিশ করে আদালত কর্তৃক দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে নিতে পারেন।
 আদালতের বিচারে দলিল সম্পাদনের মোকদ্দমা ডিক্রি হলে ওই ডিক্রি ওই আদালতে জারি দিয়ে দলিলের মুসাবিদা ও স্ট্যাম্প আদালতে দাখিল করলে আদালত দাতার পক্ষে দস্তখত করে দলিল রেজিস্ট্রি করে দেবেন।
 বায়নাপত্র দলিল
কোনো সম্পত্তি বিক্রির জন্য ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করা হয়, তাকে বায়নাপত্র বলে। বর্তমানে বায়না দলিল রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। বায়নাপত্রের মাধ্যমেও স্বত্ব হস্তান্তরিত হতে পারে। যদি কোনো ব্যক্তি বায়নাপত্র মারফত জমির দখল বুঝিয়ে দিয়ে থাকেন এবং মূল্যের টাকা গ্রহণ করে থাকেন এবং বিশেষ কারণে দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে দেননি বা দিতে পারেননি; যেহেতু দখল বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং গ্রহীতা দখল বুঝে নিয়ে ভোগদখল করছেন, সেহেতু সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৩ ধারামতে আংশিক বিক্রয় কার্যকর হয়েছে। অতএব, জমিতে খরিদ্দারের স্বত্ব হয়েছে বলে গণ্য হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

buttons=(Accept !) days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !
To Top